জরায়ুর অস্বাভাবিক রক্তপাতের কারণ
জরায়ুর অস্বাভাবিক রক্তপাতের কারণ
এটা প্রকৃতিরই আইন যে প্রত্যেক মেয়ে বা নারীরই নিয়মিত প্রতি মাসে তিন থেকে সাত দিন জরায়ু থেকে মোটামুটি পরিমাণে রক্তপাত হয়, যাকে আমরা বলি ঋতুস্রাব বা মেনস্ট্রুয়েশন। নারীদেহের অভ্যন্তরে জটিল সব ক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশই এ ঋতুস্রাব।
যতক্ষণ পর্যন্ত এটা পরিমিত পরিমাণে থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত সবকিছুই ঠিক থাকে। কিন্তু স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি রক্তপাত হলেই দেখা দেয় জটিলতা। আর এই জটিলতাকে আরো জটিলতর করে তোলে নারীদের অজ্ঞতা,ভয়,কুসংস্কার ও লজ্জা। বর্তমান আধুনিক দুনিয়ায় যেখানে চিকিৎসার সব রকম ব্যবস্থাই বিদ্যমান,সেখানে তাঁরা চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে চুপচাপ থাকেন। এই লজ্জা আর কুসংস্কারের ধোয়া থেকে নারীদের উদ্ধার করে তাঁদের সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনাটা আমাদেরই দায়িত্ব।
স্বাভাবিক বলতে আমরা কী বুঝি?
যদিও পৃথিবীর সব পূর্ণবয়স্ক নারীরই ঋতুস্রাব হয়,তবুও তাঁদের খুব কম সংখ্যকই এটা সম্বন্ধে জানে। অস্বাভাবিক মাসিক সম্বন্ধে আলোচনার আগে আমাদের বুঝতে হবে, কোনটা স্বাভাবিক ঋতুস্রাবচক্র। আর এ জন্য নারী জননতন্ত্র সম্বন্ধে কিছুটা জ্ঞান থাকা আবশ্যক। নারীদেহের জননতন্ত্র গঠিত মূলত একটা জরায়ু বা ইউটেরাস দিয়ে, যার ওপরের দিকে দুই পাশ থেকে দুটি নল চলে গেছে,তাকে বলা হয় ডিম্ববাহীনালি বা ফ্যালোপিয়ান টিউব। আর নিচের দিকে জরায়ু যোনিপথ বা ভ্যাজাইনার মাধ্যমে বাইরে উন্মুক্ত। ফ্যালোপিয়ান টিউবের শেষ প্রান্তে দুই পাশে থাকে দুটি ওভারি বা ডিম্বাশয়। যার যেকোনো একটি থেকে প্রতি মাসে একটি করে ডিম্বাণু বা ওভাম নির্গত হয়ে ফ্যালোপিয়ান টিউবের মাধ্যমে জরায়ুতে আসে পুরুষের শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হওয়ার জন্য। আর সময়টা হচ্ছে প্রতি ঋতুস্রাবচক্রের ১৩ অথবা ১৪তম দিন।
ইস্ট্রোজেন আর প্রোজেস্টেরন—এ দুই হরমোনের প্রভাবে এরই মধ্যে জরায়ুতে অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। পাতলা জরায়ুর দেয়াল হয়ে উঠেছে পুষ্ট,নতুন নতুন রক্তবাহী শিরা সেখানে সৃষ্টি হয়েছে। পরে দুই-তিন দিনের মধ্যে যদি জরায়ুতে শুক্রাণু আসে, তাহলেই শুরু হয়ে যায় গর্ভধারণ প্রক্রিয়া। আর যদি তা না হয়, তাহলে ২৮ থেকে ৩০তম দিনে জরায়ুতে গড়ে ওঠা পরিপুষ্ট দেয়াল তার রক্তবাহীনালিসহ জরায়ুর মূল দেয়াল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আসে;আর এ প্রক্রিয়া চলে পরবর্তী তিন থেকে সাত দিন। এ সময়টাতেই হয় রক্তপাত,যাকে আমরা ঋতুস্রাব বা মেনস্ট্রুয়েশন বলে থাকি। আর এই ২৮ বা ৩০ দিনের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটাকে বলা হয় ঋতুস্রাবচক্র বা মেনস্ট্রুয়াল সাইকেল।
স্বাভাবিক ঋতুস্রাবের সময় রক্তপাত হয় তিন থেকে সাত দিন। তবে প্রথম দুদিন রক্তরক্ষরণ হয় একটু বেশি পরিমাণে। তার পর আস্তে আস্তে রক্তের পরিমাণ কমে আসে এবং আবার ২৮ থেকে ৩০ দিন পর এটার পুনরাবৃত্তি হয়। আর এই স্বাভাবিক নিয়মের কোনোরকম অন্যথা হলেই তাকে আমরা বলতে পারি অস্বাভাবিক ঋতুস্রাবচক্র।
অস্বাভাবিক রক্তপাতের প্রকারভেদ
এ ধরনের অস্বাভাবিকতাকে আমরা প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। একটি হচ্ছে জননতন্ত্রের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গের শারীরবৃত্তিক অসুবিধা, যেমন :প্রদাহ,টিউমার অথবা ক্যানসার। আর অন্যটিকে আমরা বলতে পারি ডিসফাংকশনাল ইউটেরাইন ব্লিডিং, যেখানে শারীরবৃত্তিক কোনো অসুবিধা থাকে না, সমস্যাটা থাকে ঋতুচক্রের কার্যকলাপে। এ ক্ষেত্রে নিয়মিত ঋতুস্রাবের ব্যাঘাত ঘটে এবং রক্তপাত হয় প্রচুর পরিমাণে।
প্রথমোক্ত ক্ষেত্রে ওভারি বা ডিম্বাশয়,জরায়ু ও ভ্যাজাইনা বা যোনিপথ—এসবের যেকোনো স্থানে যেকোনো ধরনের রোগই অস্বাভাবিক রক্তপাত ঘটায়। তবে এ ক্ষেত্রে ঋতুস্রাব থাকে নিয়মিত। আর এসব স্থানে প্রধানত যে রোগ দেখা যায়, তা হচ্ছে সার্ভাইকাল পলিপ, সার্ভাইকাল ইরোসন, ক্যানসার, জরায়ুর টিউমার, রিটেইনড প্ল্যাসেন্টা, এন্ডোমেট্রাইটিস, ওভারিয়ান টিউমার ইত্যাদি। এখন আমরা এসব রোগ সম্বন্ধে একটা সাধারণ ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করব।
সার্ভাইকাল পলিপ
সাধারণভাবে জরায়ুর নিচের অংশটিই সার্ভিক্স নামে পরিচিত। আর সার্ভাইকাল পলিপ হচ্ছে সার্ভিক্সে এক ধরনের রক্তনালিময় বৃদ্ধি। এ ক্ষেত্রে একটা নিয়মিত ব্যবধানে অল্প পরিমাণে রক্তপাত হয়। এই টিউমারের ওপর যেকোনো ধরনের চাপ, বিশেষত যৌনসঙ্গম অথবা মলমূত্র ত্যাগের সময় সামান্য চাই রক্তপাত ঘটায়। চিকিৎসা খুবই সহজ। ছোট্ট একটা অপারেশনের মাধ্যমেই এই টিউমার উচ্ছেদ করা যায় এবং খুব কম ক্ষেত্রেই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন হয়।
সার্ভিক্সে ক্ষয়
সার্ভিক্সে প্রদাহের ফলে এ অবস্থার উদ্ভব হয়, যেখানে অনিয়মিতভাবে অল্প পরিমাণে রক্তপাত হয়। এ ক্ষেত্রে সার্ভিক্সে থাকে প্রদাহপূর্ণ। লাল,স্ফীত এবং স্পর্শ করলেই রক্তক্ষরণ হয়। সার্ভাইকাল ইরোসন থেকে ক্যানসারের মতো জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে, সে জন্য এ ক্ষেত্রে দ্রুত পরীক্ষা এবং চিকিৎসা প্রয়োজন। ক্যানসার হয়েছে কি না, তা বোঝার সহজ পদ্ধতি হচ্ছে বায়োপসি। এখানে সার্ভিক্স থেকে সামান্য একটু অংশ কেটে নিয়ে মাইক্রোস্কোপের নিচে পরীক্ষা করা হয়।
রিটেইনড প্ল্যাসেন্টা
অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ভ্রূণের পুষ্টি জোগানোর জন্য জরায়ুর অন্তরাচ্ছদক অঙ্গবিশেষ। এটি প্রসবকালে নাড়ির সঙ্গে বেরিয়ে আসে, তাকেই প্ল্যাসেন্টা বলে। গর্ভপাত এমনকি স্বাভাবিক প্রসবের পরেও প্ল্যাসেন্টার কিছু অংশ জরায়ুতে থেকে যেতে পারে। এ অবস্থাকেই বলা হয় রিটেইনড প্ল্যাসেন্টা। এ ক্ষেত্রে জরায়ু থেকে বিপজ্জনক পরিমাণে রক্তপাত হতে পারে।
বিভিন্ন ধরনের টিউমার
মেয়েদের ক্ষেত্রে স্তন ক্যানসারে পরেই যে ক্যানসার বেশি হয়, তা হচ্ছে জরায়ুর ক্যানসার। এ ছাড়া জরায়ু ও ডিম্বাশয়ে আরো কিছু টিউমার হয়,যেমন—পলিপ, ফ্রাইব্রোমায়োমা, ফাইব্রয়েড, টিউবারকুলোসিস ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে জরায়ু থেকে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হয়। রজঃনিবৃত্তি বা মেনোপজের পরে রক্তক্ষরণ জরায়ুর ক্যানসারের ইঙ্গিতবাহী এবং এ ধরনের রক্তক্ষরণ হলে খুব ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সত্যিই ক্যানসার হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।
ডিসফাংকশনাল ইউটেরাইন ব্লিডিং
এ ক্ষেত্রে জননতন্ত্রের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ সুস্থই থাকে, কিন্তু হরমোনের বিশৃঙ্খলার জন্য মাসিক অনিয়মিত হয়ে যায়। মেয়েদের মাসিক শুরু হওয়ার সময় অথবা পরে রজঃনিবৃত্তি বা মেনোপজের প্রাক্কালে এ ধরনের রক্তক্ষরণ খুবই সাধারণ ঘটনা। আর এর কারণ হচ্ছে এ সময় হরমোনের সঠিক অনুপাতে নিঃসরণ না হওয়া। রোগীর মানসিক অবস্থার সঙ্গেও এটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানসিক চাঞ্চল্য বা উত্তেজনা,নতুন জায়গা ইত্যাদি এ ধরনের অতিরিক্ত রক্তপাত ডেকে আনে।
সাধারণ কারণগুলো
হরমোন এবং জননতন্ত্রের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গের অসুবিধা ছাড়াও শরীরের আরো বিভিন্ন অঙ্গ এ ধরনের অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণে ভূমিকা রাখে, যেমন :থাইরয়েড অথবা পিটুইটারি গ্ল্যান্ডের বিভিন্ন রোগ,হার্ট ফেইলিওর,উচ্চরক্তচাপ ইত্যাদি।
রোগ নির্ণয়ের মাপকাঠি
সব রোগীর ক্ষেত্রেই পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ক্যানসার অথবা অন্যান্য শারীরিক কারণ নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। অল্প বয়সী মেয়েদের ক্ষেত্রে ডিসফাংকশনাল ইউটেরাইন ব্লিডিং হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। চল্লিশ বিশেষত পঞ্চাশোর্ধ্ব নারীদের ক্ষেত্রে রক্তক্ষরণ সব সময়ই সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা উচিত। কেননা,এটা হতে পারে ক্যানসারের প্রাথমিক সংকেত। পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগ নির্ণয় সম্ভব।
সাইটোলজি অথবা প্যাপ টেস্ট
সার্ভিক্সে ক্যানসার নির্ণয়ের জন্য এই পরীক্ষা করা হয়। এটা খুবই সহজ ও সস্তা একটি পদ্ধতি এবং এটি করতে মাত্র কয়েক মিনিট সময় দরকার হয়। তিরিশের ঊর্ধ্বে সব নারীরই প্রতি ছয় মাস অন্তর একবার এই পরীক্ষা করা উচিত।
অন্যান্য পরীক্ষার মধ্যে আছে রক্তপরীক্ষা বিশেষ রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা আছে কি না, তা বোঝার জন্য। এ ছাড়া ল্যাপারোস্কপি, কালডোস্কপি, হিস্টেরো সালফিংগোগ্রাফি—এসব পরীক্ষার মাধ্যমেও অনেক রোগ প্রাথমিক অবস্থাতেই নির্ণয় করা সম্ভব।
চিকিৎসা
যদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায় শারীরবৃত্তিক কারণেই অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হচ্ছে,তবে চিকিৎসাও সেভাবেই করা উচিত। পলিপ,ফাইব্রয়েড,রিটেইনড প্ল্যাসেন্টা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অপারেশন দরকার হয়। চিকিৎসাক্ষেত্রে এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মেনোপজের সময় বা পরে যদি এমন অবস্থা দেখা দেয়, সে ক্ষেত্রে জরায়ু ফেলে দেওয়াই উত্তম। সে ক্ষেত্রে কোনোরকম দ্বিধা করা উচিত নয়। ক্যানসারের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অপারেশন সম্ভব না। তখন রেডিওথেরাপি বা কেমোথেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা সম্ভব।
অল্পবয়স্ক মেয়েদের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক রক্তপাত বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ফাংশনাল, রোগীকে বিশ্রাম এবং আশ্বাসদানই যথেষ্ট। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটা বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আপনাআপনি সেরে যায়। রক্তশূন্যতার ক্ষেত্রে আয়রন,ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স ইত্যাদি দেওয়া উচিত। টিউবারকুলোসিস,উচ্চ রক্তচাপ, হার্টফেইলিওর ইত্যাদি ক্ষেত্রে যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ করলে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য আর বিশেষ কিছু করার দরকার হয় না। বাকি নারীদের ক্ষেত্রে হরমোন চিকিৎসার দরকার হতে পারে, তবে তা সব সময়ই একজন ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে করা উচিত।
পরিশেষে বলা যায়,মেয়েদের কুসংস্কার,লজ্জা,ভয় ত্যাগ করতে হবে এবং কোনোরকম অসুবিধা দেখা দিলে দ্বিধা না করে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। অন্যথায় খুব সামান্যতম অসুবিধা থেকেই একটা জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়া খুবই স্বাভাবিক।
No comments