ঠিকমতো চিকিৎসা পেলে মৃগী রোগীরা ভালো থাকে
ঠিকমতো চিকিৎসা পেলে মৃগী রোগীরা ভালো থাকে...
কয়েক লাখ স্নায়ুকোষ দিয়ে মানবমস্তিষ্ক গঠিত, যা নিউরন নামে পরিচিত। এই নিউরনগুলো স্নায়ু দিয়ে শরীরের সব কয়টি অংশে অবিরাম বৈদ্যুতিক সংকেত পাঠায়। কিন্তু নিউরন থেকে হঠাৎ অতিরিক্ত বা অস্বাভাবিক বৈদ্যুতিক সংকেত পাঠানো হলে স্নায়ুকোষের স্বাভাবিক কার্যকলাপ বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে আচরণের পরিবর্তন দেখা দেয়। এতে কাঁপুনি, মুখ-হাত বেঁকে যাওয়া, পড়ে যাওয়া, মুখ থেকে লালা বের হওয়া, চোখের পাতা স্থির হওয়া প্রভৃতি দেখা দেয়। এটাই মূলত খিঁচুনি বা ইপিলেপ্সি।
গঠনগত প্রক্রিয়া
মানবদেহের নিউরনগুলোর গঠন অনুযায়ী দেহ ও প্রসেস—এই দুই ভাগে বিভক্ত। প্রসেস আবার এক্সন ও ডেন্ড্রাইটে বিভক্ত। নিউরনগুলো একে অন্যের সঙ্গে এক্সন বা ডেন্ড্রাইট বা দেহের মাধ্যমে সিন্যাপ্স তৈরি করে। নিউরনের কোষ থেকে বৈদ্যুতিক সংকেত তৈরি হয়ে এক্সন দিয়ে অগ্রসর হয়। এক্সনের প্রান্তভাগে অর্থাৎ প্রথম নিউরনের এক্সন ও পরের নিউরনের ডেন্ড্রাইটের মাঝে সামান্য খালি জায়গা, তাকে সিন্যাপ্স বলে। এক্সনের প্রান্তভাগে নিউরোট্রান্সমিটার নিঃসৃত হয়, এই রাসায়নিক পদার্থ সিন্যাপ্স ডিঙিয়ে পরবর্তী নিউরনের ডেন্ড্রাইটের রিসেপ্টদের জাগিয়ে তোলে, এতে নিউরন উদ্দীপ্ত হয়ে বৈদ্যুতিক সংকেত তৈরি করে এবং এটা ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে। মৃগীরোগে নিউরন হঠাৎ অতিরিক্ত বা অস্বাভাবিক বৈদ্যুতিক সংকেত তৈরি করে।
প্রকারভেদ
আংশিক খিঁচুনি : যদি মস্তিষ্কের একটি বিভাগে হঠাৎ অতিরিক্ত বা অস্বাভাবিক বৈদ্যুতিক কার্যকলাপ হয়, তাকে আংশিক খিঁচুনি বলে। আংশিক খিঁচুনি আবার সাধারণ আংশিক খিঁচুনি ও জটিল আংশিক খিঁচুনি এ দুই ভাগে বিভক্ত।
সাধারণ খিঁচুনি : যদি মস্তিষ্কব্যাপী অত্যধিক বৈদ্যুতিক ক্রিয়াকলাপ হয়, তাহলে সেটা সাধারণ খিঁচুনি। সাধারণ খিঁচুনি নিম্নলিখিতভাবে প্রকাশ পায়—
অ্যাবসেস খিঁচুনি : এ ধরনের রোগের ক্ষেত্রে রোগী ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। খিঁচুনি হঠাৎ করে শুরু হয় এবং হঠাৎ শেষ হয়ে যায়। রোগীর সচেতনতা লোপ পায়। এ অবস্থা ১০ সেকেন্ডের কম হতে পারে। দিনে অসংখ্যবার হতে পারে। শিশুদের বেশি হয়। সাধারণত শ্রেণিকক্ষের শিক্ষক বা বাসার টিউটর বিষয়টি প্রথম নজরে নেন। এ রোগে বাচ্চারা অ্যাবসেন্স অর্থাৎ অনুপস্থিত থাকে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে।
টনিক ক্লনিক খিঁচুনি : এ ধরনের খিঁচুনিতে চিৎকারের পরে সচেতনতা লোপ পায়। মাংসপেশি শক্ত হয়ে রোগী পড়ে যায়। তারপর সারা শরীর খিঁচতে থাকে, নাক-মুখ দিয়ে ফেনা বের হয়ে আসে, কখনো কখনো জিহ্বা কেটে রক্ত বের হয়ে যায়। শরীরে পরিধেয় কাপড়ে প্রস্রাব-পায়খানা করে দিতে পারে। এ রোগের পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ হতে সময় লাগে ৫-৭ মিনিট। রোগীর জ্ঞান ফিরে এলেও ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে বা ঘুমিয়ে যায়। ঘুম হতে ১৫ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা পরে উঠে বলে তার মাথা ব্যথা, শরীর ব্যথা ও দুর্বল লাগছে।
এটনিক খিঁচুনি : এ ধরনের খিঁচুনিতে রোগীর হঠাৎ পতন হয় বা পড়ে যায়। মাংসপেশি টান টান ভাব অর্থাৎ শিথিল হয়ে যাওয়ার ফলে রোগী নুয়ে পড়তে পারে বা মেঝেতে পড়ে যেতে পারে। এ অবস্থা কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হতে পারে।
মায়ক্লোনিক খিঁচুনি : এ ধরনের খিঁচুনিতে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেমন—হাত, পা, দেহের কোনো অংশ হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। একগুচ্ছ মাংসপেশির আকস্মাৎ ঝাঁকুনির ফলে হঠাৎ হাত বা পা ছোড়া শুরু হয়ে যেতে পারে।
কারণ
শিশুদের ক্ষেত্রে
♦ শিশুর জন্মগত সমস্যা যেমন—শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, মাথায় আঘাত লাগা।
♦ ইনফেকশন—শিশুর অথবা মায়ের গর্ভাবস্থায় জটিল ইনফেকশনে আক্রান্ত হওয়া।
♦ অতিরিক্ত জ্বর হওয়া।
♦ মেটাবলিক ডিজঅর্ডার— হাইপোগ্লাইসেমিয়া
♦ মস্তিষ্কের গঠনগত বৃদ্ধি কম হওয়া বা কটিকেল ডিজেনিসিস।
♦ বাচ্চা বা শিশুর শারীরিক টান বেশি থাকা বা ইনফেনটাইল স্পাজম।
♦ মস্তিষ্কের রক্তনালি সরু হয়ে রক্তপ্রবাহে বাধাগ্রস্ত হওয়া।
♦ বংশগত কারণ।
বড়দের ক্ষেত্রে
♦ অজানা কারণ/জেনেটিক কারণ।
♦ তরুণদের মায়ক্লোনিক অ্যাপিলেপ্সি।
♦ মাথায় আঘাত বা দূর্ঘটনার কারণে।
♦ মস্তিষ্কে টিউমারের জন্য।
♦ অ্যালকোহল বা অন্যান্য চেতনানাশক ওষুধ হঠাৎ করে বন্ধ করে দেওয়া।
♦ স্ট্রোক বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগের কারণে।
♦ মস্তিষ্কের ভেতরে ঘা তৈরি হওয়া।
♦ মস্তিষ্কের ইনফেকশন যেমন—মেনিনজাইটিস বা এনকেফালাইটিস রোগের কারণে।
♦ ডিজেনারেটিভ ডিজিজ বা মস্তিষ্কের ক্ষয়জনিত রোগের কারণে।
♦ মস্তিষ্কের ভেতর রক্তপ্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়ে রোগ সৃষ্টি করা।
এ সময় করণীয়
♦ রোগী চশমা পরে থাকলে তা খুলে ফেলুন ও মাথার নিচে বালিশ রাখুন।
♦ রোগী টাই পরে থাকলে টাই ঢিলা করে দিন, যাতে সহজে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারে।
♦ রোগীকে এক পাশ করে শুইয়ে দিন এবং শ্বাসনালি খোলা রাখুন।
♦ পাঁচ মিনিটের বেশি সময় খিঁচুনি চলমান থাকলে দ্রুত অ্যাম্বুল্যান্স ডেকে হাসপাতালে নিতে হবে।
♦ মৃগীরোগীর পরিচয়পত্র খুঁজে দেখা উচিত।
♦ রোগীকে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য রোগীর বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
পরীক্ষাসমূহ
♦ ইলেকট্রোএনসেফালোগ্রাফি (ইইজি)
♦ এমআরআই
♦ রক্ত পরীক্ষা
এ ছাড়া হেপটিক এনকেফালোপ্যাথিতে ও রক্তে ইউরিয়া বেড়ে গিয়ে খিঁচুনি হতে পারে।
চিকিৎসা
ওষুধ : মৃগীরোগ মূলত ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা যায়। মৃগীরোগের প্রকারভেদ অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া হয়। তবে আমাদের দেশে আংশিক খিঁচুনিতে কার্বামাজেপিন গ্রুপের টেগ্রিটল ব্যবহার করা হয়। সাধারণ খিঁচুনিতে সোডিয়াম ভেলপ্রোয়েট/ফিনাইটোয়েন/ফেনোবারবিটন/লেমোট্রিজিন ওষুধ ব্যবহার হয়ে থাকে।
শিশুদের জ্বরের পরে খিঁচুনি হলে ডায়াজিপাম (সিডিল)- মলদ্বার দিয়ে বা মাংসপেশিতে ইনজেকশন আকারে দিতে হয়।
প্রেগন্যান্সিতে বা ডেলিভারির পরে খিঁচুনি বন্ধের জন্য ম্যাগনেসিয়াম সালফেট, ফিনাইটোয়েন বা সোডিয়াম ভেলপ্রোয়েট দেওয়া হয়।
সার্জারি : যাদের মস্তিষ্কের টিউমার/অ্যাবসেস থাকে, তাদের সার্জারির মাধ্যমে খিঁচুনির উৎস অংশটুকু অপারেশনের মাধ্যমে ফেলে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। মস্তিষ্কে স্ট্রোক বা আঘাতের কারণে রক্ত জমলে রক্ত বের করেও খিঁচুনি নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
পরামর্শ
♦ খিচুনির রোগীদের কখনোই পুকুর, নদী ও সমুদ্রে গোসল করা উচিত নয়।
♦ আগুনের সামনে বা পাশে যাওয়া নিষেধ। মহিলাদের রান্নাঘরের কাজের ক্ষেত্রে রোগটি জানে—এমন কাউকে সঙ্গে নিয়ে আগুনের কাজ করা উচিত।
♦ ঘূর্ণায়মান ভারী যন্ত্রপাতির সামনে যাওয়া নিষেধ।
♦ ব্যস্ততম সড়কে একাকী রাস্তা পারাপার হওয়া ঠিক নয়।
♦ অতি সতর্কতামূলক চাকরি যেমন—পাইলট, ড্রাইভার, রেলগাড়ির চালক ইত্যাদি চাকরি করা যাবে না।
♦ ‘মৃগীরোগ আছে’ এমন নির্দেশিত কার্ড বা ব্রেসলেট সব সময় বহন করা উচিত।
♦ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ বন্ধ করা যাবে না।
মৃগী রোগী প্রকৃত চিকিৎসা পেলে ভালো থাকে। এতে পরিবারের অন্যদেরও ঝামেলা কম হয়। তাই কুসংস্কার বাদ দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
No comments